বাংলায় একটা প্রবাদ আছে ''ভাই বড় ধন রক্তের বাঁধন, যদি হয় ছিন্ন নারীর কারণ"।গ্রাম বাংলার আনাচে কানাচে এসব প্রবাদ ছড়িয়ে আছে। গ্রামের মানুষ এসব মনে প্রাণে বিশ্বাস করে।আমিও এর ব্যতিক্রম নই।কিন্তু বড় হওয়ার সাথে সাথে এসব বিশ্বাস কমে যাচ্ছে। যে ভাই এতো আপন সে ভাই একদিন শত্রু হয়ে যায় জমিজমার কারণে।কিছু কিছু ঘটনা দেখলে মনে হয় ভাইয়ে ভাইয়ে যে রক্তের বাঁধন থাকে তা একটা বয়সের পর কেটে যায়।
আজ একটা ঘটনা শুনে সারাদিন ভুলতে পারিনি। আমাদের পাশের ফ্লাটে একটা ভাই থাকতো চল্লিশ বিয়াল্লিশ বছর বয়স হবে।বিশ বাইশ বছর যাবৎ মালয়েশিয়া থাকে।ব্যবসা করেন এখানে।বিদেশে থাকার কারণে হয়তবা বিয়ে করেছেন দেরিতে। ওনার দুইটা মেয়ে একটার বয়স ছয় বছর, আরেকটার চার বছর। একুশ সালের জুলাই মাস মালয়েশিয়াতে তখনও লকডাউন চলে।ওনার জ্বর আসে।জ্বর এক সপ্তাহের বেশি স্থায়ী হয়।হাসপাতালে গিয়ে পরীক্ষা করার পর করোনা ধরা পড়ে।তখন তিনি সুস্থ। তাই হাসপাতাল থেকে ঔষধ দিয়ে বাসায় পাঠিয়ে দেয় । বলে নিয়ম মেনে চলতে আর অবস্থার অবনতি হলে হাসপাতালে চলে যেতে।হাসপাতালে তখন মুমূর্ষু রোগীকে জায়গা দেওয়া যাচ্ছিলোনা তাই যারা মোটামুটি ফিট তাদের রাখতেন না।
ওনি বাসায় আসার পর নাকি জ্বর আসা যাওয়া করে। হঠাৎ একদিন কিচেনে পানি নিতে এসে সেখানে পড়ে যায়। এরপর হাসপাতালে ফোন করলে এম্বুলেন্স এসে দেখে ওনি মারা গেছেন। তখন আর হাসপাতালে নেয়নি। সকালে পুলিশ এসে লাশ নিয়ে যায়।
সে যাইহোক এবার মূল কথায় আসি।ওনার ভাইও থাকে মালয়েশিয়ায়। ভাইয়ের বাসা থেকে ওনার বাসায় আসলে পাঁচ দশ মিনিট লাগে।ওনি হাসপাতালে যাচ্ছিলেন না শ্বাস কষ্ট হচ্ছিল, তাই পাশের বাসার অনেকে ওনার ভাইকে নাকি ফোন করেছে তাও আসেনি।এরপর মৃত্যুর খবর পেয়েও আসেনি, করোনা হয়েছে তাহলে ওনিও মারা যেতে পারেন। মালয়শিয়ায় কবর হয়েছে, জানাজাতে নিজের দেশেরও কেউ ছিলো না। ভাই চাইলেই অংশ নিতে পারতেন।
কত হাজার হাজার ডাক্তার করোনা রোগীদের চিকিৎসা করেছে, নার্স সেবা করেছে তাদের কয়জন মারা গিয়েছে। ওনি ভয় পান তাহলে প্রটেকশান নিয়ে যেতে পারতেন কিন্তু যাননি।ঐ ভাই মারা যাওয়ার পর আমাদের ফ্লোরে কোয়ারান্টাইন দিয়ে দেওয়া হয়।যেদিন কোয়ারান্টাইন খুলে পরের দিন ওনার ভাই বাসায় আসে।ওনার রুমের জিনিসপত্র, টাকা পয়সা যা ছিলো নিয়ে চলে গেলো। আজব ব্যাপার তখন আর করোনাকে ভয় পেলেন না।জীবাণু থেকে যেতে পারে ,সে সন্দেহও হয়নি তাহলে তো আসতেন না।কিংবা কিছুদিন পরে আসতেন।
এবার আসা যাক ঐ ভাইয়ের ব্যবসার কথায়। ভাই এখানে ব্যাগ আর জুতোর ব্যবসা করতেন। দোকান আছে, অনেক বড় দোকান।কয়েক লক্ষ টাকার মালামাল সহ দোকানটা উত্তরাধিকার সুত্রে পেয়ে গেলেন তার ভাই।ওনারও ভালো অবস্থা। নিজের ব্যবসা আছে।আগেই বলেছি ভাইয়ের দুটো মেয়ে আছে।বউটার বয়স পঁচিশ ছাব্বিশ বছর হবে।দোকানটা মালামাল সহ বিক্রি করে দিলে দশ পনেরো লক্ষ টাকা এমনিতেই চলে আসতো।আর একটা কমর্চারী দিয়ে চালালেও মাসে এক দেড় লক্ষ টাকা কোনো ব্যপার না।
বড় ভাই মারা গেছে,তার বউ বাচ্চাগুলো নিয়ে অথৈ সাগরে হাবুডুবু খাচ্ছে ওনার দায়িত্বছিলো ওদের সম্পদগুলো সঠিকভাবে ওদের কাছে পৌঁছে দেওয়া। কিন্তু তিনি দোকানটা নিজের করে নিলেন। অবশ্য ভাবীর সাথে বলেছেন ওনাকে নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা দিয়ে দিবেন।এই শর্তেই দোকানটা নিলেন।কাল একজন আমাকে বলছিলো ওনি ভাইয়ের বউ বাচ্চদের দোকান থেকে প্রতি মাসে সাত হাজার করে টাকা দেন।
একথা শুনার পর কি করবো আমি বুঝতে পারিনি।ওনারা ঢাকায় থাকেন। এই সাত হাজার টাকা দিয়ে কি সংসার চালানো সম্ভব!এছাড়াও এতো সুখে থাকা মানুষগুলোর পক্ষে এতোটা মানিয়ে চলা সম্ভব? সাত হাজার টাকার কথা শুলনে কেনো আমি এতো অবাক হলাম জানেন?
কারণ এইদোকান থেকে প্রতিদিন লাভ হয় বিশ হাজারের বেশি।মাসে ত্রিশ দিন ব্যবসা। সাপ্তাহিক ছুটির দিন আর সরকারি ছুটির দিন একলাখও হয়।ঐসব বাদ দিলাম গড়ে বিশ হাজার ধরলেও মাসে ছয় লাখ।সেখান থেকে সাত হাজার টাকা দেয়।গড়ে এক শতাংশও হয়না।সেই ভাইয়ের সাথে কেমন রক্তের বাঁধন আমার জানা নাই। আবার এদের মধ্যে কোনো নারীও নাই কারণ তাদের পরিবার বাংলাদেশে।স্বার্থপর এ পৃথিবীতে স্বার্থ ছাড়া সবকিছু যেনো মূল্যহীন।
